কাচারি তে জড়সড় হয়ে বসে আছি আমরা কাজিনরা। বক্কর হুজুর আমাদের ভূতের গল্প শুনাচ্ছেন। উনি নাকি জ্বীন দেখেছেন একবার কাচারির পেছনের পুকুর পাড়ের জাম গাছে। সত্য মিথ্যা জানিনা তবে আমার চোখের সামনে যেনো ভেসে আসলো পুকুর পাড়টা,যেখানে ইয়া লব্বা সাদা আলখাল্লা পরে একটা জ্বীন দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। গ্রামে বাড়িতে গেলে সন্ধ্যার পর কাচারি তে বসে এমন গল্প আমাদের প্রায়ই শুনা হতো। বক্কর হুজুর ছিলেন আড্ডার প্রাণ। নানা রঙের গল্প শুনাতেন উনি আমাদের। এক গল্প দুইবার শুনাতেন না কখনো। উনার গল্পের স্টক ঝর্ণার পানির মতো। শেষ হতো না কখনো। বক্কর হুজুর ছিলেন আমাদের বাড়ির মক্তব এর আরবি শিক্ষক। উনি অনেকটা লজিং শিক্ষকের মতো। থাকতেন কাচারির পাশের একটা রুমে। আরেকটা রুমে থাকতেন আমাদের নজির জেঠা। ওনাকে আঞ্চলিক ভাষায় আমরা নজির জেইয়া বলতাম। উনি আমাদের ক্ষেতে কাজ করতেন। দাদার আমল থেকেই তিনি এই বাড়িতে। জন্মের পর থেকেই ওনাকে আমরা দেখছি। সন্ধ্যার কাচারির আড্ডায় উনিও থাকতেন মাঝে সাঝে। ও আচ্ছা কাচারি কি? শহরে যারা বেড়ে উঠেছে তাদের অনেকেই হয়তো কাচারির নাম শুনেনি। কাচারি হলো একটা গ্রামের বাড়ির মধ্যমণি। আগের কালে বেশীরভাগ বাড়িতেই কাচারি থাকতো। টিন আর বেড়ার তৈরি একটা ঘর,অনেকটা কলেজ ইউনিভার্সিটির কমন রুমের মতো। সেখানে আড্ডা হতো,গল্প হতো,মিটিং বসতো। মেহমানরা আসলে সেখানে বসতেন। থাকার ব্যবস্থাও থাকতো সেখানে। বড় ছোট সবাইকেই আকর্ষন করতো এই কাচারি। হ্যামিলনের সেই বাঁশিওয়ালার মতোই যেনো সবাইকে কাছে ডাকতো।
গ্রামে যারা বড় হয়েছেন কিংবা গ্রামে যাদের আসা যাওয়া ছিল বা আছে তাদের কাছে কাচারি হল একটা আবেগের জায়গা। কতো শত রঙিন স্মৃতি যে জড়িয়ে যে আছে কাচারি নিয়ে সেটার হিসেব নেই। আড্ডার প্রাণ কেন্দ্র ছিল এই কাচারি।
রঙিন শৈশব হারিয়ে গেলেও আমাদের কাচারি টা কিন্তু হারায়নি। তবে পুরনো সেই কাচারি টা এখন আর নেই। মেরামত হয়েছে অনেকটা। তবে নেই আমাদের সেই বক্কর হুজুর। নজির জ্যাঠা এখন কবরের বাসিন্দা।
আমাদের কাচারি তে এখনো আড্ডা হয়। এখনো গ্রামে গেলে বর্ষার বৃষ্টি আমরা উপভোগ করি কাচারিতে বসে। কাচারি থেকে আমাদের বাড়ির প্রবেশের রাস্তা টা দেখা যায়। দু পাশে ধান ক্ষেত, আর মাঝ খানে রাস্তাটা। বৃষ্টি দেখার জন্য এর চাইতে সুন্দর জায়গা আর নেই।
কাচারি তে বসে রাস্তার দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে কল্পনা করি, এই বুঝি লুঙ্গি আর সেন্টু গেঞ্জি গায়ে নজির জ্যাঠা কাজ শেষে বাড়ি ফিরবেন বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে। কর্দমাক্ত রাস্তায় বার বার হোঁচট খাবেন তিনি। একটু পর সন্ধ্যা নামলে হারিকেন এর আলোয় বসে বক্কর হুজুর আমাদের গল্প শুনাবেন।