কুরবানীর সেই স্মৃতিগুলো

সকালে ঘুম থেকে উঠে বাজার এ যাওয়ার পথে দেখলাম গ্যারেজে দুটো লাল গরু বাঁধা। একটা বেশ বদরাগি। দারোয়ানকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম দাম কত? যাইহোক এর পর যথারীতি নিজের কাজে বেরিয়ে পরলাম। রিক্সায় উঠেই মনে পরলো ছোট বেলার কোরবানির ঈদের স্মৃতি। আহ! সেই উৎসব, সেই আমেজ।

ছোটবেলায় সাগরের তীর ঘেঁষা এক উপজেলায় বড় হয়েছি। একটু দূর হওয়ায় এলাকার বড় ভাই-বোনেরা সব থাকতো বিভিন্ন শহরের বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ ক্যাম্পাসের আশেপাশে। কোরবানির প্রথম আমেজটা শুরু হতো তাঁদের দেখলেই। পুরো এলাকা সন্ধ্যার পর আড্ডায় জমে উঠতো। সর্বপ্রথম যেই গরুটা এলাকায় ঢুকতো তাঁকে নিয়ে সকলের গবেষণা আর আগ্রহ দেখা যেতো। বাসায় গিয়েই বায়না ধরতাম হাটে যাওয়ার।
যেদিন আমাদের গরু কিনবে সেদিন দুপুরের আগেই এক ধরনের উত্তেজনা কাজ করতো- আমাকে হাটে নিবে তো? চুপচাপ বাবার ডাকের জন্য অপেক্ষা করতাম। যেই আব্বা বলতো কি ব্যাপার তাড়াতাড়ি করো চলো গরু নিয়ে আসি, তখন আমার আনন্দের সীমা থাকতো না। হাটে যাওয়ার পথে বাবাকে বলতাম “আব্বা লাল রাগি গরু কিনবো, আর এবার আমি পছন্দ করবো’ বাবা একটা হাসি দিয়ে বলতো আচ্ছা চল আগে যাই।
হাটে ঢুকতেই আরেক উত্তেজনা এদিক ওদিক সেদিক গরু আর গরু। একেরপর এক গরু দেখছি,কয়েকটা ভীষণ পছন্দ হলো কিন্তু আমাদের বাজেটের সাথে মিললো না। সেদিন আর গরু কেনা হলো না। বিষণ্ণ মন নিয়ে ঘরে ফিরলাম। আশপাশের প্রায় সব বাড়িতেই গরু চলে এসেছে, বাসায় গিয়ে কোনো কিছুতেই আর মন বসলো না। সারারাত মন খারাপ করে পরদিন সকালেই গেলাম পাশের এক হাটে সেখানেও পছন্দ হলো না। এবার আমার চরম মন খারাপ হলো। এক বন্ধু এসে বললো আমাদের একটা বলদ গরু এনেছে আমার পছন্দ হয়নি, যদি তোদের গরুটা রাগি হয় তাহলে আমি তোদের গরুকেই আদর করবো। বিকাল থেকেই বসে রইলাম- যদি বাবা নিয়ে আসে একটা গরু এই আশায়। এলাকায় একের পর এক গরু ঢুকছে। কালো,লাল, সাদা,কোনটির বড় শিং আবার কোনটির গলায় মালা। এভাবে একেরপর এক গরু আসলো। এক সময় দূর থেকে দেখাম একটা রাগি গরু দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে। অপরিচিত ২ জন মানুষ গরুর গলার রশি ধরে গরুর সাথে সাথে দৌড়াচ্ছে। অনেক্ষন অপেক্ষা শেষে যখন বাসায় গেলাম দেখলাম আমার বাসার সামনেই সেই রাগি গরু আর অপরিচিত দুই ব্যাক্তি। আমার বাবার নাম জিজ্ঞেস করায় বুঝতে আর বাকী রইলো না এটাই আমাদের গরু। আনন্দে আমার বুক ভরা উল্লাস। গরুটা ছোট ছিলো কিন্তু অসম্ভব সুন্দর আর মায়াবি চেহারা সাথে লম্বা লম্বা শিং। রাত ১১ অবদি ছিলাম গরুর কাছে।
পরদিন ঘুম ভাঙতেই নাস্তার আগেই ছুটে গেলাম গরুর কাছে। সারাদিন গরুর রশি ধরে মাঠে চষে বেড়ালাম, কি খাওয়া কি ঘুম! গরু নিয়েই সারাদিন আমি আর আমার সেই বন্ধু ঘুরতে লাগলাম। রাতে ওর থাকার জন্য জাহের আংকেল কে বলে লাইট এর ব্যবস্থা করলাম, মশার কয়েল দিলাম। অবিকল দৃষ্টিতে গরুর যাবর কাটা দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে ঘরে গিয়ে শুয়ে পরলাম। এভাবে ৪ টা দিন পার করার পর ঈদের আগের দিন রাতে ওকে কাল জবেহ করা হবে এটা ভাবতেই কান্না চলে আসলো। ওকে আদর করে রাতে ঘুমালাম। ঈদের দিন নামাজ শেষে দেখলাম আব্বার সহকারী সাধন কাকা গরুটাকে গোসল করাচ্ছে। একেরপর এক গরুকে জবেহ করা হচ্ছে। হুজুররা বিসমিল্লাহ্ আল্লাহু আকবার বললেই আমার মনের ভিতরে চাপ অনুভব হলো। যেহেতু আব্বা নিজেই কোরবানি দিবে তাই একটু দেরিতেই আমাদের গরুকে জবাই করা হবে। এই অল্প সময়েই কল্পনা করতাম ইস! যদি আব্বা এসে বলে থাক এই গরুটা এবার জবাই করবো না তাহলে ১২ মাসই আমার প্রিয় গরুটাকে পেতাম। এক সময় কসাইরা দেখতাম আমার প্রিয় গরুটার পায়ে রশি বাঁধছে আমি আর কান্না ধরে রাখতে পারলাম না। ওকে যখন শোয়ানো হলো ওর চোখটা আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। আমি দুঃখ পাচ্ছি তাও অবাক হয়ে দেখছি সেই রাগি গরুটা আজ কেনো শান্ত হয়ে গেলো? এক সময় ওর দেহ নিথর হয়ে গেলো। আমি ভাবতে লাগলাম কেনো গরুটা আজ রাগ দেখালো না, তবে কি সে সৃষ্টিকর্তার বার্তা পেয়ে গিয়েছিলো? যোহরের নামাজের পর মুনাজাতে আমার শিশুমন সেই রাগি গরুটার জন্য দোয়া করলো। এভাবে প্রত্যেকটি ঈদ গিয়েছে আর বুঝতে পেরেছি প্রিয় প্রানীটিকে আসলে উৎর্সগ করাই হলো কোরবানির মহত্ত্ব। আজ এতো বছর পরও মনে পরে সেই দিনগুলো। হঠাৎ রিকশাওয়ালা বললো মামা এইখানে নামবেন, কথাটা শুনেই সেই ঘোর থেকে বের হলাম। এখন নিজেই কোরবানি করার সামর্থ্য হয়েছে, তবে ছেলেবেলার সেই কোরবানির মতো এখন আর উত্তেজনা নেই, নেই প্রানীর জন্য মায়া আর ভালোবাসা। আসলে ছোটবেলার পবিত্র শিশুমন ঈদ যেমন রঙিন ভাবে উৎযাপন করে ঠিক তেমনি কোরবানির আসল ও প্রকৃত শিক্ষা আসলে আমরা ছোটবেলাতেই শিখে যাই। বাসায় এসেই লিফটে ছোট্ট দুইভাই এর সাথে দেখা, একজন আরেকজনকে বলছে ইয়েস! ফাইনালি আমাদের গরু আসছে… ওদের আনন্দ দেখে আবারো আমারো মনে পরলো ছোটবেলার সেই রঙিন স্মৃতিগুলো। আসলে ঈদের আনন্দটা ছোটদের আর আমাদের বড়দের দায়িত্ব সেই আনন্দটা ঠিকভাবে আয়োজন করা, ঠিক যেমনটা আমাদের মুরব্বিরা করে গেছেন। আল্লাহ্ আমাদের সকলের কোরবানি কবুল করুক।

About The Author

Leave a Reply

Related Posts

No Related Post